আব্দুল কাদের মোল্লা কসাই কাদের নন। বক্তব্যটি প্রদান করেছেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ দলীয় সাবেক এমপি, মেধাবী রাজনীতিক, তরুণ প্রজন্মের প্রিয় মুখ গোলাম মাওলা রনি। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘মিরপুরের কসাই কাদের সম্পর্কে আমি পড়ালেখা করেছি। আব্দুল কাদের মোল্লা কসাই কাদের নন। এ বিষয়ে আমি যে কারো চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি আছি। নতুন করে তদন্তের জন্য তিনি নিজের অর্থায়নে রাজি বলে জানালেন গোলাম মাওলা রনি। সাংবাদিকরা কাদের মোল্লার সঠিক তথ্য জানতে চাইলে, আমি অর্থ ঢালবো, বলেন গোলাম মাওলা রনি। এ বিষয়ে তাঁর মৃত্যুদন্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আওয়ামীলীগের এই সাবেক সংসদ সদস্য।’
গোলাম মাওলার এ বক্তব্যটি গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। কারণ তিনি কোন সাধারণ ব্যক্তি নন। একজন তরুণ উদ্যোক্তা, বিশিষ্ট কলামিষ্ট, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও তোখড় পার্লামেন্টারীয়ান। যার বাড়ি আর কাদের মোল্লার বাড়ি বলা যায় একই এলাকায়। অতএব তিনি না জেনে, না বুঝে, আবেগতাড়িত হয়ে হুজুগে বক্তব্যটি প্রদান করেছেন এমনটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি কি কারণে ভিন্ন আদর্শিক অবস্থানে থাকার পরেও সাহস করে এ বক্তব্য প্রদান করেছেন সেটিও তাঁর এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে নিজেই লিখেছেন। আর সেটি হলো, তিনি জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তার কাছে কাদের মোল্লার পাঠানো চিরকুট।
গোলাম মাওলা রনিকে লেখা কাদের মোল্লার চিরকুট:-
প্রিয় রনি,
যদি কখনো সময় পাও এবং তোমার ইচ্ছা হয় তবে আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বলো বা লিখো- কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়। আমার আত্না কিয়ামত পর্যন্ত কাঁদবে আর কসাই কাদের তখন কিয়ামত পর্যন্ত অট্টহাসি দেবে।
গোলাম মাওলা রনি লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার অন্তিম অনুরোধ রাখতে গিয়ে তিনি এ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। অন্তিম মুহূর্তের একটি অছিয়ত পালন করে মানুষ হিসেবে তিনি নিজের কর্তব্যটুকু পালন করেছেন বলে জানান।
স্ট্যাটাসে রনি, যেসব তরুণ কাদের মোল্লার ফাঁসি দাবি করছেন, তাদেরকে কাদের মোল্লার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আমিরাবাদে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন এবং খোঁজখবর নিতে বলেছেন।
আমি মনে করি, তরুণ প্রজন্মের অগ্রসেনানী গোলাম মাওলা রনির এ আহবানে সকলের সাড়া দেয়া উচিত। বিশেষ করে তরুণ সমাজের ঐ অংশটির (তথাকথিত শাহবাগ প্রজন্ম) প্রতি সনির্বদ্ধ অনুরোধ থাকবে, শাহবাগ মোড়ে লাফালাফি ও চেঁচামেঁচি করে গলা ফাটানোর পরিবর্তে সত্যকে জানার চেষ্টা করুন। তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য সত্য ও সুন্দরকে আলিঙ্গন করা। মিথ্যা ও কলুষতাকে পরিহার করা। আশা করি ডিজিটাল যুগের তারুণ্য কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের মিথ্যা প্রপাগান্ডা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত অপতৎপরতার শিকার হয়ে সত্য পথ হারাবেন না।
আমি একইভাবে মিডিয়ার বন্ধুদের প্রতি বিনীত আহবান জানাই, আপনারাও গোলাম মাওলা রনি সাহেবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সত্য উদঘাটনের মহৎ উদ্দেশ্যে তার আহবানে সাড়া দিন। মিডিয়াকে তো বলা হয় সমাজের দর্পণ। কোন প্রভাবশালী মহলের অবৈধ চাপে সত্যকে গোপন করা আপনাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নয়। রনি সাহেবের চ্যালেঞ্জ প্রদানের সময় তো প্রায় ১ বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আপনাদের এতো সময় লাগছে কেন? সত্য উদঘাটিত হলে আপনাদের মধ্য থেকেও ওই অংশটির মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যেতে পারে, যারা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আয়োজিত তথাকথিত শাহবাগ মঞ্চে একাত্ত্বতা প্রকাশ করেছিলেন। কয়েক’শ লোককে কয়েক হাজার, কয়েক হাজারকে কয়েক লক্ষ দেখিয়ে মিনিটের পর মিনিট লাইভ কাস্ট করেছেন। পত্রিকার পুরো কাভার পেইজ জুড়ে তরুণ প্রজন্মের দাবি ফাঁসি-ফাঁসি নিউজ হেডলাইন করেছেন। কারো কারো কবর অনুসন্ধান করে তার হাড়গোড়ের মধ্যে রাজাকারের গন্ধ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কোন অপচেষ্টাই বাকী রাখেননি। তারা হয়তো ভাবছেন, সব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে লাভ কি? কিন্তু মনে রাখবেন, সত্যকে কিছু সময়ের জন্য গোপন রাখা যেতে পারে, সারাজীবনের জন্য নয়। সুতরাং সত্য আপনা-আপনি একদিন প্রকাশিত হবেই ইনশাল্লাহ। সেদিন আপনারা আমরা না থাকলেও সে সময়ের প্রজন্ম সত্যের সন্ধান পেয়ে সত্য পথের পথিক শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার আদর্শ কে বুকে ধারণ করবে আর মিথ্যা ও তার অনুসারীদের ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করবে।
আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাবো, আপনি মেহেরবাণী করে গোলাম মাওলা রনি সাহেবের বক্তব্যটিকে নিয়ে একটু ভাবুন। কারণ এব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়-দায়িত্ব আপনারই। আপনার সরকারের আমলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন যিনি আপনারই এলাকার লোক। একই এলাকার মানুষকে জানার জন্য কোন গবেষণার দরকার হয় না। আপনি বৃহত্তর ফরিদপুরের যেকোন লোককে জিজ্ঞেস করলেই ঐ এলাকার যেকোন মানুষ সম্পর্কে জানা অসম্ভব কিছু নয়। এর জন্য বই পুস্তক ঘাটাঘাটি কিংবা তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন নেই। কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তারপরও আপনার সরকার ও দেশবাসির সদয় অবগতির জন্য শহীদ আব্দুল কাদের সম্পর্কে তাঁর পারিবারিক, একাডেমিক ও কর্মজীবনের কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি:-
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলাস্থ সদরপুর উপজেরার চর বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের জরিপের ডাংগি গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সানাউল্লাহ মোল্লা ও মাতার নাম বাহেরুন্নেসা বেগম। আব্দুল কাদের মোল্লা ছিলেন নয় ভাইবোনের মাঝে চতুর্থ।
তিনি মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হন।
ফরিদপুরের বিখ্যাত রাজন্দ্রে কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৮ সালে তিনি একই কলেজে থেকে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু প্রবল আর্থিক সংকটের কারণে এরপর তাকে শিক্ষকতা পেশায় আত্ননিয়োগ করতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া হয়নি তখন আর। ফরিদপুরের এস এস একাডেমি নামক একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন কিছু কাল।
১৯৬৯ সালের পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি করার জন্যে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যলয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। মিষ্টভাষী ও আকর্ষণীয় চারিত্রিক মাধূর্যের অধিকারী হওয়ায় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবার প্রিয়পাত্র। মুক্তিযুদ্ধের কারণে ১৯৭১ সালে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা না হওয়ায় তিনি বাড়ি চলে যান।
২৩ মার্চ ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জেসিও মফিজুর রহমানের ডাকে এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। ১ মে তারিখে হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত তাঁর এ ট্রেনিং অব্যাহত থাকে।
পরবর্তীতে তিনি ১৯৭২ এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। যুদ্ধের সময় প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকের মতো আব্দুল কাদের মোল্লার লেখাপড়াতেও ছন্দ পতন ঘটে। ১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই ই আর বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে আবার ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রীতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন। এম.এড পরীক্ষার রেজাল্টের পরে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ্যের দায়িত্ব পালন করেন। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে রিসার্স স্কলার হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী সেন্টারে যোগ দেন।
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা সম্পর্কে উপরে প্রদত্ত তথ্য সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই আপনি অবগত রয়েছেন। আমি যতটুকু জানি আপনিও কাদের মোল্লাকে অত্যন্ত কাছে থেকেই জানতেন। এক সময় এমন ছিল আপনিও কোন প্রয়োজনে তাঁকে আপনার কাছে ডেকে নিয়ে পরামর্শ চেয়েছেন এবং তিনিও আপনার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছেন। বিষয়টি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই আপনার বিবেক এব্যাপারে কথা বলবে। আমি মনে করি, কাদের মোল্লা সম্পর্কে গোলাম মাওলা রনির প্রত্যেকটা কথাই তথ্যভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ। তার এই বক্তব্যের সুত্র ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরো বিষয়টির সত্য উদঘাটনে পুনরায় তদন্তের উদ্যোগ নিতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসলে অন্তত কাদের মোল্লার আত্না শান্তি পাবে। তাঁর ছেলে-মেয়ে পরিবার-পরিজন গ্লানি মুক্তভাবে সম্মানের সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারবে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিবেশি হিসেবে তাঁর ব্যাপারে হক আদায় করে আপনিও কিছুটা ভারমুক্ত হতে পারেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি ইচ্ছা করলেই এ ফাঁসি পিছিয়ে দিতে পারতেন। আপনার হাতে সে সুযোগও এসেছিল। আপনাকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, তুরস্কের তখনকার প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাভি পিল্লাই, কমিশনের স্বাধীন অন্তত আরো দু’জন সদস্য, মানবাধিকার সংগঠন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক বিশ্বনেতা ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অনুরোধ করা হয়েছিল (যার কিয়দংশের ব্যাপারে আপনি নিজেই সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন) কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করার ব্যাপারে। আপনি চাইলেই এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারতেন। আপনার সরকার তড়িঘড়ি করে ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের ফলে রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধান একজন নাগরিককে ন্যায়বিচারের স্বার্থে যতগুলো আইনিধাপের সুযোগ দিয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে সেটিও প্রযোজ্য হলো না। এক্ষেত্রে আইনের সর্বশেষ ধাপ রিভিউ করার সুযোগ না দিয়ে তাঁর প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, তা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার আব্দুল কাদের মোল্লা:
পারিবারিক, একাডেমি ও ঐতিহাসিক সূত্রমতে দেখা যাচ্ছে, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭১ সালে ঢাকাতেই ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ গ্রামের বাড়ী ফরিদপুরে অবস্থান করছিলেন। দালাল আইনে ৩৭ হাজার লোকের নামে মামলা করা হলেও তখন তার নামে কোথাও একটি জিডিও করা হয়নি। কোন হত্যাকান্ডের সাথে যুক্ত থাকলে তিনি সত্তরের দশকের এ উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে অধ্যয়ন করা এবং ঢাকা শহরের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকতে পারা কিভাবে সম্ভবপর হয় যৌক্তিক কারণে সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই ৪২ বছর পর বর্তমান সরকার মানবতাবিরোধী বিচারের নামে মিরপুরের কসাই কাদেরকে কাদের মোল¬া হিসাবে চিহ্নিত করে তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করেন।
তাছাড়া কাদের মোল্লার সাংবিধানিক অধিকারগুলোও তাঁর ব্যাপারে প্রযোজ্য হলো না কেন? রাষ্ট্র কর্তৃক তাড়াতাড়ি মৃত্যুদন্ড কার্যকরের হেতুটা কি? এ প্রশ্নটি যুগ-যুগ ধরে মানুষের মনে থেকেই যাবে।
অতিসম্প্রতি মহমান্য সুপ্রীম কোর্টের এপিলেট ডিভিশন কর্তৃক কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের প্রদত্ত রায়ে সম্মানিত বিচারপতিগণ সর্বসম্মত রায় প্রদান করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করার সুযোগ পাবেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কাদের মোল্লা এ সুযোগটি পেলেন না কেন? তাহলে কি রাষ্ট্র কর্তৃক সংবিধানের প্রদত্ত সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ হলো না? এর দায় নিবে কে? কাদের মোল্লাকে রিভিউয়ের সুযোগ দিলে তিনি হয়তো ন্যায় বিচার পেতেন। তাহলে তো তিনি মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বেঁচে যেতেন। তাইতো গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সহ দেশ ও বিদেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডকে জুডিশিয়াল হত্যাকান্ডের সাথে তুলনা করেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের পরিবারের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সিাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেছেন, মানবতাবিরোধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও আপনারা দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। যার ফলে শুরু থেকেই এ কার্যক্রমের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্যে পূর্বের অপরাধের জন্য পরে ইচ্ছা মতো কালো আইন তৈরি করে, কোন কোন ক্ষেত্রে আইনের রেট্রসপেক্টিভ ইফেক্ট দিয়ে, সাজানো স্বাক্ষীর মাধ্যমে, সুবিধামতো পর্যাপ্ত সময় নিয়েও চাহিদা মতো রায় না পেয়ে রায়ের পরও বারবার আইন সংশোধন করে প্রতিপক্ষের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের যে নজীর আপনার সরকার স্থাপন করেছে তা যুগ-যুগ ধরে কলঙ্কজনক ইতিহাস হয়ে থাকবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেহেরবাণী করে দেয়ালের কথা কান পেতে শুনুন। মানুষের মুখে মুখে একটিই কথা, নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে, বিরোধী আন্দোলনকে দমন করে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও চিরস্থায়ী করতে মানবতাবিরোধীদের বিচারের ট্রামকার্ড ব্যবহার করছেন। এবং নিজের প্রতিবেশি পাশের বাড়ির মানুষ শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা, সাবেক মন্ত্রী জননেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, যাদের বংশ বুনিয়াদ আপনার অতিপরিচিত। যাদের সাথে অনেক ওঠাবসা করেছেন, নিজ হাতে আপ্যায়ন করিয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। রাজনৈতিক প্রয়োজনে যে দলের উর্ধ্বতন নেতাদের দোয়া ও সমর্থন পাওয়ার জন্যে আপনার দলের পক্ষ থেকে ডেলিগেশন পাঠিয়েছেন, এক টেবিলে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। যে দলের নেতাদের ইমামতিত্বে আপনার দলের নেতারা জামায়াতে নামাজ আদায় করেছেন। কর্মসূচি নির্ধারণে আপনার দলের নেতাদের বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা যৌথ মিটিং শেষে আদর আপ্যায়ন করেছেন। আপনাদের নিজস্ব ধাঁচের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট ও রাজনৈতিক অপকৌশলে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে তাঁদেরকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ইত্যাদি না হয় বলতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র নামের মিল থাকার প্রেক্ষিতে চিন্হিত রাজাকার, খুনী, মীরপুরের কসাই কাদেরের দোষ আপনার পাশের বাড়ির কাদের মোল্লার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে সভ্যতা-ভব্যতা, ন্যায় ও মানবতাবোধের কবর রচনা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অনেককে এ কথাও বলতে শুনা যায়, আপনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। যার ফলে আপনি থামতে পারছেন না। কিন্তু আপনাকে থামতেই হবে। নতুবা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে এ গন্তব্যহীন যাত্রা আমাদের এ দেশ ও জাতিকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাবে, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সহজ কোন পথ খোলা থাকবে না। এবং যার অনিবার্য অশুভ পরিণতির দায়-দায়িত্ব থেকে অনেকেরই রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়।
গোলাম মাওলা রনি সাহেব তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে কাদের মোল্লার ফাঁসিকে একটি বড় রাজনৈতিক ভুল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজকের ভুলের খেসারত সমগ্র জাতি একদিন দেবে।’ তিনি বলেন, ‘যখন কোন ভুলের প্রতিবাদ করার কেউ না থাকে তখন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।’ তিনি দাবি করেন, ‘কসাই কাদের এবং আব্দুল কাদের মোল্লা এক ব্যক্তি নন।’
তিনি বলেন, ‘আর এ কারণেই আমি কাদের মোল্লা সম্পর্কে আমার জানা তথ্য সাহস করে বলেছি বা লিখেছি। যা তাঁর পরিবারের কেউ এমনকি জামায়াতের কেউ জেনেও লিখতে পারেনি। কাদের মোল্লার বিচার সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ানোর পেছনে স্রেফ রাজনৈতিক ইচ্ছাকে দায়ী করেন তিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমার এ লেখা তাদের জন্য, যারা নির্ভূল সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন করতে চায়, যারা আগামী ২৫ বছর পরের চিন্তা করে তাদের জন্য। যারা শুধু আজকের চিন্তা করছে তাদের জন্য নয়।’ এখন থেকে প্রায় ১ বছর আগে ২৮ ডিসেম্বর ২০১৩ শনিবার রাজধানীর তোপখানা রোডে তার নিজস্ব ব্যবসায়িক কার্যালয়ে বাংলা নিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কাদের মোল্লাকে নিরাপরাধ দাবী করেন গোলাম মাওলা রনি।
গোলাম মাওলা রনি মিথ্যা অভিযোগে দন্ডিত একজন সৎ রাজনীতিবিদের জীবনের অন্তিম ইচ্ছা রক্ষা করতে গিয়ে সত্য উচ্চারণে যেমনিভাবে সাহস করে এগিয়ে এসেছেন। তেমনিভাবে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষ, তরুণ প্রজন্ম, সাংবাদিক বন্ধুগণ, আইনজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সহ সকলেই যদি ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কিংবা কেউ রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধী বলবে ইত্যাদি সাত-পাঁচ না ভেবে সত্য লিখনে, বলনে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে আসেন, তাহলে ইনশাল্লাহ সত্য এবং সত্যবাদীরা বিজয়ী হবেন দেশ ও জাতি জালিম স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্তি পাবে। মিথ্যার ধ্বজাধারীরা লাঞ্চিত, অপমানিত ও নিশ্চিত পরাজিত হবে। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমি নিশ্চিত এদেশের মানুষ একদিন জানবেন আব্দুল কাদের মোল্লা কসাই কাদের নন। সেদিন সত্য জানার আনন্দে মানুষের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যাবে, শান্তি পাবে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার বিদেহী আত্না। আর মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়ে আজকে যারা দম্ভ করে বুক ফুলিয়ে সত্যকে পদদলিত করে ক্ষমতার স্বাদ চুষিয়ে গ্রহণ করছে, সেদিন তাদের আদর্শের অনুসারীরা মাথা নত করে অপরাধীর বেশে পালিয়ে বেড়াবে। তাদের দিকে মানুষ ছি-ছি থু-থু নিক্ষেপ করবে। মহান আল্লাহর তায়ালা’র পবিত্র বাণী- ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত, মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী।’
লেখকঃ কেন্দ্রিয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় প্রকাশিতঃ লিঙ্ক