শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী রাহিমাহুল্লাহ এর সাথে আমার বেশ কিছু স্মৃতি হৃদয়ের মানসপটে বার বার ভেসে ওঠে। তাঁর সাথে আমার প্রথম ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল ২০০১-২০০৫ এই সময়ে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেল, অফিস ও প্রকাশনার দায়িত্বে থাকাকালীন উনার স্নেহ, ভালোবাসা ও মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে আমাকে ধন্য করেছিলেন। ছাত্র জীবন শেষ করে উনার হাত ধরেই বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা করেছি। এছাড়াও আমার দাম্পত্য জীবনও উনার উপস্থিতিতে এবং উনার দোয়া ও ভালোবাসায় শুরু করেছি। উনি আমাদের জন্য সেই সময়ে প্রাণভরে দো’য়া করেছেন ও তাঁর পক্ষ থেকে হাদিয়া প্রদান করে আমাদেরকে ঋণী করেছেন।
শহীদ মাওলানা নিজামী রাহিমাহুল্লাহ এর সাথে আমার আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের প্রেক্ষিতে। সময়টি ছিল ২০০১, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। যদিও ২০০৭-এর নির্বাচন পরবর্তীতে বাতিল হয়ে যায়। এই তিনটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাঁর সাথে নিবিড়ভাবে সাঁথিয়ার থানা অফিসে, ডাক বাংলোতে একসাথে থাকার সুযোগ হয়েছে। আমি উনাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। সারাদিন সফর শেষে বিশেষ করে রাতে আমরা একসাথে খেতাম। খাওয়ার সময় তিনি আমাকে প্রায়ই যে কথাটি বলতেন সেলিম, তোমাদের এলাকায় দুধ-কলা তো খুব ভালো চলে, তাই না? আবার কখনও বলতেন, তোমাদের এলাকার লোকদের মাঝে ফেলোশিপ খুব ভালো, তাই না? এরকম কিছু কথা তিনি আমাকে বলতেন। তিনি যখন কেন্দ্রীয় অফিসে বসতেন, আমি তখন মগবাজারে রমনা থানার আমীর ছিলাম। চার বছর এই দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ের মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তিনি দুই দুইবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁর গ্রেফতার ও মুক্তি আন্দোলসহ অনেক বিষয়েই উনার সাথে আমার স্মৃতি রয়েছে। তাছাড়া তিনি অফিসে আসা-যাওয়ার পথে আমাদের অনেকের সাথে দেখা হত যেহেতু আমি এই থানার আমীর ছিলাম। সেই সুবাধে উনি আমকে ডাকতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন।
তিনি ছিলেন এলাকার গণমানুষের একজন প্রিয় নেতা। তাঁর এলাকার বিভিন্ন সভা-সমাবেশগুলোতে দীর্ঘসময় ধরে তিনি কথা শুনতেন। কথা শুনতেন বেশি, বলতেন কম। অনেকের কথা শুনার পর তিনি বলতেন, আমি কথাগুলো শুনলাম এবং সবাই মিলে এগুলো সমাধান করব ইনশাআল্লাহ। তিনি সবাইকে সম্পৃক্ত করে কথা বলতেন। তিনি যেখানেই থাকতেন সেটা সাথিয়াতে হোক বা ঢাকায় সরকারি বাসভবনে হোক বা নিজের বাসায় হোক তাঁর এলাকার লোকজন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সহজেই তাঁর কাছে আসতে পারতেন, যোগাযোগ করতে পারতেন। সাধারণ মানুষের কাউকেই তিনি হতাশ করতেন না। তিনি তাঁর এলাকায় এতোটাই সর্বজন গ্রহণযোগ্য ছিলেন যে, তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে তাঁকেই খুৎবা দিতে হত, ইমামতি করতে হত। তিনি তাঁর এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যেমন- রাস্তা-ঘাট, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ এবং কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তাঁর দুইবার এমপি থাকাকালীন (একবার মন্ত্রী ছিলেন) এলাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে এটা সাথিয়ার ইতিহাসে বিরল।
তাছাড়া তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, অমায়িক একজন মানুষ। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে আমি একবার গিয়েছিলাম সেখানে। তিনি অনুপস্থিত ছিলেন বাকীরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি তখন নিজেকে একজন সাধারণ দর্শনার্থী হিসেবে উনাদের সাথে কথা বলছিলাম। আমি তাঁর জীবন সম্পর্কে বাকীদের কাছ থেকে জানতে চাচ্ছিলাম। সবাই উনার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। উনারা বলতেছিলেন যে, আমরা এমন ভালো মানুষ মন্ত্রী হিসেবে আর কখনও পাইনি।
একজন বামপন্থী সচিব প্রথমে উনার সাথে চাকুরী করতে চাননি এই বলে যে, তিনি নিজামী সাহেবের সাথে চাকুরী করবেন না। এরপর ভাগ্যক্রমে তিনি নিজামী সাহেবের সাথেই চাকুরী করেছেন এবং স্মৃতিচারণে বলেছিলেন যে, “আমার জীবনে বহু মন্ত্রী দেখার সুযোগ হয়েছে কিন্তু উনার মতো এত সময়মতো ফাইল স্বাক্ষর করা, যেকোনো বিষয়কে গভীরভাবে দেখা মন্ত্রী আমি কখনও পাইনি”। তিনি দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন (১) কৃষি মন্ত্রণালয় (২) শিল্প মন্ত্রণালয়। তাঁর আমলে দুটি মন্ত্রণালয়েরই ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।
তিনি বিশ্বের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের প্রভাবশালী একজন নেতা ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থাগুলো, বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী মুসলিম ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের যে তালিকা তৈরি করেছিল, সেখানে বহুবার উনার নাম কখনও একশো আবার কখনও বা পঞ্চাশের মধ্যে উঠে এসেছিল। তিনি একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর ভাষাশৈলী, শব্দচয়ন ছিল অত্যন্ত মার্জিত, পরিশীলিত এবং মাধুর্যমণ্ডিত। তাঁর বক্তব্য ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে যখন তিনি কথা বলতেন সবাই নিরবে উনার বক্তব্য শুনতেন। তিনি এক্সপাঞ্জ হওয়ার মতো কোনো শব্দচয়ন করতেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ। তিনি যুক্তিসঙ্গত দালিলিক কথা বলতেন। তিনি ছিলেন সত্যিই একজন দাঈ-ইলাল্লাহ।
সাহিত্য জগতেও তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি অনেক বই লিখেছেন। তিনি প্রখর মেমোরির একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। সম্পূর্ণ কাল্পনিক, মিথ্যা, বানোয়াট মামলা সাজিয়ে উনাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। এরকম একজন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব বেঁচে থাকলে হয়তো রাজনীতির চেহারাটাই বদলে যেত, কিন্তু আমরা তাঁকে হারিয়েছি। আমরা তাঁর শাহাদাত দিবসে তাঁর শাহাদাত কবুলের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দো’য়া করছি এবং তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলো আমরা যাতে সম্পূর্ণ করতে পারি তার জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি। মহান আল্লাহ তাঁর পরিবার ও সকল সহকর্মীদেরকে এই শোক সহ্য করার তাওফিক দান করুন। আমীন।।