পৃথিবীতে প্রতিটি বিদায়ই বেদনার। আর সে বিদায় যদি হয় না ফেরার দেশে এবং প্রিয় মানুষটি যদি হন আমাদের জন্মদাতা বাবা অথবা মা তাহলে তো কথাই নেই। এ পৃথিবীতে যারা বাবা-মা হারিয়েছেন এ কষ্ট শুধুমাত্র তারাই অনূভব করতে পারেন। এটি ভাষায় প্রকাশ সত্যিই কষ্টসাধ্য।
আমার শ্রদ্ধেয় বাবা মরহুম আব্দুল গফুর গত ১২ মার্চ ২০১৫ শুক্রবার দিবাগত রাত অর্থাৎ শনিবার ভোর রাত ২.১৫ মিনিটে জীবনের ৯৫ টি বসন্তের এক বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে এই বসন্তে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চিরবিদায় নিয়েছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।)
আমার বাবা ছিলেন, সজ্জন, নির্বিবাদি, পরোপকারী, ন্যায়নিষ্ঠ একজন আদর্শ মানুষ। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মানুষের উপকার করা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তিনি একজন বিশিষ্ট সালিশান ছিলেন। যা সত্য যা সঠিক তার পক্ষে ছিলেন উচ্চকিত। অধিকার হারা, ন্যায়বিচার বঞ্চিত মানুষের জন্য তিনি ছিলেন এক বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল। নিজ এলাকা তো বটেই অনেক দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা তাঁকে সালিশান মেনে তাঁর কাছে আমানত গচ্ছিত রাখত ও তাঁকে অনেকটা বাধ্য করত সালিশে উপস্থিত থাকার জন্য। শেষের দিকে এসে শরীর না কুলালে প্রায়শই অপারগতা প্রকাশ করতেন। কিন্তু লোকেরা নাছোড় বান্দা। সালিশি বৈঠকের স্থান পরিবর্তন করে অনেক সময় আমাদের বাড়িতেই নিয়ে আসা হতো। আর অনেক সময় তিনি শুয়ে শুয়ে তাতে অংশ নিতেন। কারণ তাঁর ন্যায় নিষ্ঠতার ব্যাপারে সকলের ছিল অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস।
আমার শ্রদ্ধেয় বাবা ছিলেন অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রুচিশীল মানুষ। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও নিয়মিত গোসল করা, কাপড়-চোপড় ও বিছানা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিয়মানুবর্তি ও আত্ননির্ভরশীল মানুষ। শেষ দিনগুলোতে পারত পক্ষে কাউকে কষ্ট না দিয়ে নিজে একাই বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে যাতায়াত, অজু গোসল সারা ইত্যাদি করার চেষ্টা করতেন। যদিও তাকে সহযোগিতা করার জন্য সার্বক্ষনিকভাবে বাড়িতে থাকা তার ছেলে-মেয়ে, ছেলেদের বউরা সহ অন্য সহযোগিরা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তবুও কারো অপেক্ষা না করে নিজেই খাওয়া-দাওয়া সহ সব কিছুই নিজের হাতে করার চেষ্টা করতেন। পরিবারের সদস্যরা সহ প্রতিবেশী, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কাউকে কষ্ট দিয়েছেন বলে কেউ বলেনি। অসুস্থ হওয়ার পর কিছু সময়ের জন্য পাশে থাকার সুযোগ হয়েছিল, দেখেছি শত শত লোক তাঁর সংজ্ঞাহীন অবস্থায়ও তাঁর নিথর শরীরে হাত স্পর্শ করে তাঁর কাছে দুঃখ প্রকাশ করা ও তাঁর দোয়া নিতে চেষ্টা করছেন। এ থেকে বুঝা যায় তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে কত প্রিয় ছিলেন। তিন বেলা খাবার আর বাদ ফজর ও বাদ মাগরিব দু’বার হালকা চা-নাস্তা এ ছিল তার নিয়মিত খাবারের রুটিন। তবে তা খেতেন অত্যন্ত সময়মতো। পরিমিত খাবার কিন্তু তা হতে হবে অত্যন্ত সুস্বাদু ও হালাল খাবার। খাবার শেষে অবশ্যই মিষ্টি জাতীয় কিছু থাকতেই হবে। সে জন্য বারো মাস আমাদের বাড়িতে দুধ ও কলা ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়াও নারিকেলের মিষ্টি, মুরুব্বা কিংবা কাঁঠালের দিনে আম-কাঁঠাল এ ছিল তাঁর প্রিয় খাবার।
বাবা ছিলেন আপদমস্তক একজন ব্যবসায়ী মানুষ। বহু ধরনের ব্যবসা তিনি করেছেন। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে হালখাতার সময় তাঁর বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসে জিলাপি আর রসগোল্লা খাওয়ার কথা মনে পড়ছে। মাঝ খানে তিন চার বছর সৌদি আরবে অবস্থান করা ছাড়া বাকী পুরো জীবনটাই তিনি বাড়িতে থেকে হালাল ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্ষেত-খামার করার মধ্য দিয়ে একটি বৈচিত্রময় সময় পার করেছেন। আর সাথে সাথে আমরাও তার বৈচিত্রময় কর্ম তৎপরতা দারুণভাবে উপভোগ করেছি। তার সমস্ত প্রচেষ্টার অন্যতম লক্ষ্য ছিল, আমাদের সুখ-উন্নতি আর সফলতা। এ জন্য বৈধ কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখেননি তিনি। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন রাত-দিন। তাঁকে কখনো অলস সময় কাঁটাতে দেখিনি। তিনি ছিলেন কাজের কাজী। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি বাড়িতে এবং বাড়ির পাশের জমিতে নানা ধরনের ফল-ফলাদি কিংবা শাক-সবজির চাষ করতেন। অর্থাৎ কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকতেন। আমরা পাঁচ ভাই বোন এবং চাচাতো ভাই বোন এবং বোনের জামাইয়েরা সবাই বাবাকে বাবা বলেই ডাকতেন। আর তাঁর সকল নাতি নাতনিরা তাঁকে মহাজন দাদা (মাজন দাদা) বলে ডাকতো। তিনি মহাজন হিসেবেই সমাজে পরিচিতি পেয়েছিলেন এবং সকলেই তাঁকে সেভাবেই সম্মোধন করতেন।
বাবাকে ঘিরে অনেক স্মৃতিই আজ আমার মনে দোলা দেয়। এই একটি মাত্র ছোট লেখায় সব বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। ছোটকালে বিশেষ করে আমার বয়স যখন ১০/১৫ বছর তখন মাঝে মধ্যে মুড়িয়া হাওরে যেতাম। বাবা বড়-বড় বিলের দু’চারটা কূপ কিনে রাখতেন। শুকনো মওসূমে একেকটা কুপ থেকে মাছ ধরার জন্য মেশিন বসাতেন আর সে জন্য শিরনি করতেন। আমি গেলে মহাজনের ছেলে হিসেবে বড় বড় হালুয়ার গোল্লা (লোকাল ভাষায় তুষা শিরনি) কুপ থেকে কই ও মাগুর মাছ দিয়ে দিত। আনন্দে আত্নহারা হয়ে সেগুলো নিয়ে বাড়িতে আসতাম। মা মজা করে মাছ বাজি ও রান্না করতে পারতেন। মায়ের পাশে বসে সেই রান্না করার দৃশ্য, রান্নার ঘ্রাণ উপভোগ করতাম। তারপরে মজা করে খেতাম। বাবার ওসিলায় বহু বড়-বড় বিলের নানা পদের বড়-বড় মাছ আল্লাহ খাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।
বাবা ছিলেন নামাজের ব্যাপারে পাবন্দ। ৫ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামায়াতের সহিত আদায় করেছেন। শেষ দিনগুলোতে কারো না কারো কাঁধে ভর করে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করতেন। আমি যতবার বাড়িতে যেতাম তাঁকে হাতে ধরে মসজিদে নিয়ে যেতাম। এটা আমার অত্যন্ত ভালো লাগতো এবং বাবাও অনেক খুশি হতেন। নিয়মিত তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করতেন, এক্ষেত্রে কোথাও মেহমানদারিতে গিয়ে রাত্রি যাপন করলেও তাহাজ্জুত ছাড়তেন না। আর নামাজ শেষে উচ্চকণ্ঠে মোনাজাত করতেন। ফলে তার মোনাজাত বহুবার শুনার সুযোগ হয়েছে আমার। মোনাজাতে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের জন্য দোয়া করতেন। আমার নিরাপত্তা ও কল্যাণ কামনা করে বিশেষভাবে মোনাজাত করতেন।
তিনি ইসলামী আন্দোলন ও নেতৃবৃন্দকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন ও নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন। বিশেষ করে প্রফেসর গোলাম আযম, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, ডা: শফিকুর রহমান, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক ফজলুর রহমান, শিবিরের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের সার্বিক খোঁজ-খবর নিয়মিত জিজ্ঞেস করতেন। মাঝে মধ্যে খুব বেশি করে আমার জন্য কান্নাকাটি করে দোয়া করতেন। একদিন আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁর দোয়া শুনার পর তাকে বললাম, বাবা আপনি কিছু মনে না করলে একটা পরামর্শ দিতাম। তিনি বললেন বল, আমি বললাম, আপনি আমার জন্য এতো বেশি পেরেশান হয়ে দোয়া করেন, অথচ আমি যে পথে চলি সে পথে তো আরো হাজার-হাজার ছেলে চলে। যারা সবাই আপনারই সন্তানতুল্য। তারাও আমার মতো পরীক্ষার সম্মুখীন। সুতরাং শুধু আমার জন্য আল্লাহর কাছে এতো না বলে আপনি সকলের হেফাজতের জন্য আল্লাহর কাছে বলবেন, তাহলে আল্লাহর দরবারে আপনার দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হবে। ফলে ইনশাল্লাহ আমি সহ আমরা সকলেই হেফাজত থাকবো। বাবা বললেন, নতুন বাবা হয়েছো তো এখনো বুঝ নাই সন্তানের ব্যাপারটা পিতা-মাতার কাছে আলাদাই থাকে। আর তাছাড়া আমি সকলের জন্যই দোয়া করে থাকি। তবে তুমি যখন পরামর্শ দিয়েছো এখন থেকে আরো বেশি করে দোয়া করবো। এরপর থেকে ইসলামী আন্দোলন ও নেতৃবৃন্দের জন্য আরো বেশি সময় নিয়ে দোয়া করতেন।
আজ আমি এতিম। বিশেষ করে বাবার এই দোয়ার বরকত থেতে দৃশ্যত এতীম। আমার জন্য পেরেশান হয়ে আর তাঁকে পথ পানে চেয়ে থাকতে হবে না। জীবনের বড় একটি সময়ে এ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। যখনই কোথা থেকে রওনা করেছি গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত ছটফট করে দোয়া করতেন আর খোঁজ-খবর নিতে থাকতেন। আজ তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আল্লাহ তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন।
বাবা সারাজীবন সুস্থই ছিলেন। বড় কোন অসুস্থতা কখনো তাঁকে পায়নি। গত বছরের ৯ নভেম্বর সংবাদ পেলাম তিনি হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সাথে সাথে তাঁকে সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। বাবা এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর শরীরে খাবার সেলাইনও পুষ করা যাচ্ছিল না। ১০ নভেম্বর ২০১৪ আমি ঢাকা থেকে তাঁকে দেখার জন্য সিলেটে গেলাম। হাসপাতালে আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে সামিহা জাহিন, সায়েমা জারিন ও ছেলে আব্দুল্লাহিল জারিফ আল-দ্বীনকে সাথে নিয়ে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছি। বাবা তাঁরও ৮/১০ ঘন্টা পূর্ব থেকে কোমায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে আমরা পৌছার কিছুক্ষণ পূর্ব থেকেই তিনি আবারো একটু একটু নাড়াচাড়া শুরু করলেন। হাসপাতালে পৌছে আমি আমার পরিচয় দিলে আমাকে, আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে জাহিন, জারিন ও ছেলে জারিফকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। আমরাও তাঁর মাথা ও শরীরে হাত বুলিয়ে তাঁর স্পর্শ অনুভব করলাম। তাঁর শিউরে বসে কিছুক্ষণ পড়ালেখা করে মোনাজাত করে এক ধরনের শেষ বিদায় দিয়ে এম্বুলেন্সের মাধ্যমে তাঁকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। আমার ছেলে জারিফ ও দুই মেয়ে জাহিন-জারিন বাবাকে বহনকারী ট্রলি ঠেলে নিয়ে এম্বুলেন্সে উঠানো পর্যন্ত তার খেদমত করার চেষ্টা করলো। যা দেখে সত্যিই আনন্দিত হয়েছি।
কৌশলগত কারণে বাবার এম্বুলেন্সের সাথে বাড়িতে যাওয়া হলো না। পরের দিন আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি যখন বাড়িতে পৌঁছাই তখন ১০ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২.৩০টা। বাবার শিউরে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে চিনেছেন কিনা? জবাবে ইঙ্গিত সূচক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলেন। এর পর আবার তিনি কোমায় চলে গেলেন। আমরা ধরে নিলাম তিনি হয়তো আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। ডাক্তার এসে পালস্ টেস্ট করে বললেন, শুধু দোয়া করা ছাড়া এই মুুহুর্তে আর কোন কিছু করণীয় নেই। শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাকী। মাগরিবের পূর্বেই আমি ঢাকা সিলেট সহ সাংগঠনিক দায়িত্বশীল, নিকট আত্নীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে সর্বশেষ অবস্থা অবহিত করে দোয়া চাইলাম।
এরপর মাগরিবের নামাজ আদায় করে আবারো বাবার শিউরে যেয়ে বসলাম। বাবার মাথা কপাল-নাক ও মুখে হাত দিয়ে স্পর্শ করে তাঁর দোয়া ও বরকত পাওয়ার চেষ্টা করছি। মন তখন মোমের ন্যায় বিগলিত। চোখ তখন অশ্রুসজল। মুখে কোন ভাষা আসছে না। মনে বাবার অনেক স্মৃতি তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ঠিক তখনি আরেকটি ঘটনা ঘটে গেল। বাবার যোগ্য উত্তরসুরি উনার নাতি অর্থাৎ আমার ছেলে আব্দুল্লাহিল জারিফ কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমার কোলে উঠে বসলো। আর আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা কি হয়েছে, কাঁদছো কেন? উত্তরে আমি বললাম, তোমার দাদার জন্য দোয়া করো, তিনি অসুস্থ। আল্লাহ যেন তাঁকে সুস্থ করে দেন। এটা বলতে না বলতেই জারিফ লাফ দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অব্যহতভাবে চুমু দিতে থাকলো। এবং বললো আল্লাহ আমার দাদাকে সুস্থ করে দাও। সে এমনভাবে চুমু খেল অর্থাৎ তার ভালোবাসা প্রকাশ করলো সত্যিই আমি অবিভূত হয়ে গেলাম। সবচেয়ে অলৌকিক ঘটনা ঘটলো তার এ ভালোবাসার প্রকাশ ও মোনাজাতের ১ মিনিট যেতে না যেতেই বাবা হঠাৎ করে আবার চোখ খুললেন ও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে কিছু বলতে চাইলেন। যেটি কিছুই বুঝা গেল না। এর পরের ঘটনা হলো, আস্তে আস্তে তাঁর অবস্থা আরো উন্নতির দিকে যেতে থাকলো। এবং সেই থেকে ২০১৫ সালের ১৫ই মার্চ পর্যন্ত আল্লাহর মেহেরবাণিতে পুরো ৪ মাস তিনি বেঁচে ছিলেন। সিলেটের হাসপাতালের ডাক্তাররা যেখানে বলেছিলেন আমাদের আর কিছু করার নেই, আপনারা নিয়ে যান, আল্লাহ-আল্লাহ করেন, অর্থাৎ দুনিয়ার প্রচেষ্টা যেখানে শেষ হয়ে যায় আল্লাহ চাইলে সেখানে বান্দাকে হায়াত দিতে পারেন। এটা হলো তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
যদিও এই ৪ মাসের মধ্যে প্রথম দুই মাস মোটামুটি খোজ-খবর রাখতে পেরেছিলাম। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে শেষ দু’মাস তেমন খোঁজ-খবর নিতে পারি নাই। এজন্য নিজেকে বড় অপরাধি মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে, যে একটি টেলিফোন করে বাবা-মার খোঁজ-খবর নেয়াটাকেও নিরাপদ ভাবা যাচ্ছে না। অনেক সময় সাংগঠনিক দায়িত্বশীল বা শুভাকাঙ্খিরাও ফোন করতে সতর্কতার আশ্রয় নিতে বলেন। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের বর্তমান অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে আমাকে ক্ষমা করবেন এবং আমার বাবার আত্নাকে আমার উপর সন্তুষ্ট করে দিবেন। এই প্রত্যাশাই করছি।
মৃত্যুর ১৫/২০ দিন আগে একবার খুবি সংক্ষিপ্তভাবে কথা বলেছিলাম বাবার সাথে। একটি কথাই বাবা বলেছিলেন, চলে আস। তার এই আকুল আবেদনে এই মেসেজই পেয়েছিলাম, তিনি চলে যাচ্ছেন দুনিয়া থেকে। হয়ত শেষবার আমাকে দেখতে চাচ্ছেন। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। দেশ জুড়ে অত্যন্ত খারাপ সময় যাচ্ছে। একদিকে হরতাল অবরোধ অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় যাঁতাকল। কিভাবে উনাকে দেখতে যাব। দায়িত্বশীলদেরকে বলবো সেই ভরসাই পাচ্ছিলাম না। দায়িত্বশীলরা আবার কি মনে করেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, এটা মনে হয় দায়িত্বশীলদের ব্যাপারে আমি ভূল ভাবছি। কেননা এসব ব্যাপারে তারা তো সহানূভূতিশীল না হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। সাহস করে প্রথমেই সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল জনাব ডা: শফিকুর রহমান সাহেবকে আব্বার অবস্থা অবহিত করে সার্বিক বিষয়ে পরামর্শ চাইলাম। শফিক ভাই আমার আব্বার অবস্থা আগে থেকেই খুব ভালো করেই জানতেন। আর তিনি এসব ব্যাপারে বরাবরই অত্যন্ত উদার এবং বাস্তববাদী। ফলে তিনি সহজেই রাজী হয়ে গেলেন। সিটির দায়িত্বশীল অনুমোদন দিলে দেরি না করে এখনি রওনা করতে বললেন। তারপর ফোন দিলাম সম্মানিত সিটি আমীর জনাব মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানকে। তিনিও সোজা বললেন, চলে যান এবং আরো কিছু বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে ছুটি প্রদান করলেন। আমি আল্লাহর শুকরিয়া জানাই যে, আল্লাহ আমাকে যথা সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার তাওফিক দিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে আমার শ্রদ্ধেয় দুই জন দায়িত্বশীলকে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে তাদের সুস্থত-দীর্ঘায়ু ও সমস্ত কল্যাণ কামনা করছি এই জন্য যে, তারা যদি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দিয়ে আমাকে সহযোগীতা না করতেন, তাহলে আমার আব্বার শেষ বিদায় অনুষ্ঠান অর্থাৎ জানাযার নামাজে অংশ নেয়া আমার জন্য কঠিন হতো। কারণ আব্বা ঐদিন রাতেই অর্থাৎ ১২ মার্চ শুক্রবার দিবাগত রাত ২.১৫ মিনিটে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
আমার আব্বার ওসিয়ত ছিল আমি যেন তার জানাযার নামাজ পড়াই। ২০০৪ সালে লন্ডনের ভাইদের দাওয়াতে শিবিরের সভাপতি হিসেবে লন্ডনে সফরে গেলে আব্বা চিন্তিত হয়ে মাকে বলেছিলেন, ও ফিরে আসতে দেরি হলে, এরি মধ্যে আমি মারা গেলে আমার জানাযার নামাজ পড়াবে কে? অর্থাৎ তাঁর একান্ত ওসিয়ত ছিলো আমি যেন তাঁর জানাযার নামাজ পড়াই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে লাখে শুকরিয়া এই কঠিন অবস্থার মাঝেও তিনি আমাকে আমার বাবার শেষ ওসিয়ত পূর্ণ করার তাওফিক দিয়েছেন।
আমি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাই যারা আমার বাবার মৃত্যুতে দোয়া করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ সহ অনেক জায়গায় দোয়ার মাহফিল করা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাই আমার উপজেলা বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা সর্বস্তরের মানুষের প্রতি। বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মী বৃন্দ যারা আমার বাবাকে শেষ দেখা ও জানাযায় অংশগ্রহণ করে আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। সিলেট মহানগরী ও জেলা এবং মৌলভীবাজার জেলা সহ অন্যান্য জায়গা থেকে যারা জানাযায় অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশেষ করে জামায়াত-শিবির নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ যারাই শোকবাণী দিয়ে আমার বাবার রুহের মাগফিরাত কামনা করেছেন, তাদের সকলকে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
সর্বোপরি যারা টেলিফোন করে কিংবা মেসেজ পাঠিয়ে আমাদের সান্তনা জানিয়েছেন, তাদেরকে জানাই শুকরিয়া-জাযাকুমুল্লাহ। আর যারা টেলিফোন করেও আমাকে পাননি তাদের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। সকলের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, আমার বাবার রুহের মাগফিরাত ও তাঁর জান্নাতুল ফেরদাউস লাভের জন্য সকলেই দোয়াতে তাঁকে স্মরণে রাখবেন এই আমার একান্ত কামনা।
যাদের উসিলায় এ দুনিয়ায় আমরা আলোর মুখ দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং যাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় তিল-তিল করে গড়ে উঠা আমাদের এ জীবন, তাদের ঋণতো অপরিশোধ্য। শুধুমাত্র মা’বুদের শিখানো বাণী-দিয়েই তাঁর কাছে আজ ফরিয়াদ- “ওয়া ক্বোর রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা”। হে! আল্লাহ দুনিয়ার এ সংক্ষিপ্ত জীবনে আমরা যেমনি এক পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম, জান্নাতেও আমদের এভাবে একত্রে থাকার সুযোগ করে দিও। আমীন।।
লেখকঃ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।