বিশেষ প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরকে নিজেদের রাজ্য করার সুযোগ পেয়েছিল ভারত। যেই শর্তে কাশ্মীরকে নিজেদের রাজ্য বানিয়েছিল সেই শর্ত উঠিয়ে নিয়েছে তারা। অর্থাৎ সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মার্যাদা বিলুপ্ত করেছে দেশটি।
এক সময়ের স্বাধীন কাশ্মীর কার্যত এখন তিনটি দেশ দ্বারা অধিকৃত। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ‘আজাদ কাশ্মীর’ নামে পরিচিত। চীনও দখল করেছে একটা অংশ। ১৯৬২ সালে ভারতের কাছ থেকে যুদ্ধ করে দখলে নেয় ‘আকসাই চীন’। ভারত দাবী করে এটা তাদের অধিকৃত ‘লাদাখ’ এর অংশ আর চীন দাবী করে এটা তাদের জিনজিয়ান প্রদেশের অংশ। একই সময় কাশ্মীরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের কাছে ছেড়ে দেয় পাকিস্তান। আর ভারত শাসন করছে ‘জম্মু কাশ্মীর’।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২৫ সাল থেকে এই তিন দেশের অধিকৃত কাশ্মীর একত্রে শাসন করতেন হিন্দু রাজা হরি সিং। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ধারণা করা হচ্ছিল কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হবে। কিন্তু রাজা চেয়েছিলেন স্বাধীন কাশ্মীর রাষ্ট্র। তখন কাশ্মীরের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ছিল শেখ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’। কিন্তু শেখ আব্দুল্লাহ ও রাজা হরি সিং কাশ্মীরকে ধীরে ধীরে ভারত ভুক্তির দিকে নিয়ে যান।
এদিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হতে হলে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরের রাজা তাই দুই দেশের নেতাদের সাথে চুক্তি করতে চাইলেন। কাশ্মীরকে স্বীকৃতি দেয়ার সেই চুক্তিতে পাকিস্তান স্বাক্ষর করলেও ভারত করলো না। ভারত কাশ্মীরকে দখল করতে যাচ্ছে এই আশঙ্কায় পাকিস্তান থেকে পাঠানরা কাশ্মীর আক্রমণ করে বসলো। বিপদ এড়াতে ভারতকে ডেকে নিলেন হিন্দু রাজা। বিনিময়ে ভারতের অঙ্গরাজ্য হওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। শর্ত অনুযায়ী পৃথক সংবিধান, পতাকা তথা পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন পেলো কাশ্মীর। ভারত এইসব শর্ত তাদের সংবিধানের ৩৭০ ধারায় নিশ্চিত করলো। কিন্তু ৭০ বছর আগে স্বাধীনতা হারানোর পর ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে এবার স্বাধীকারও হারালো কাশ্মীর। এছাড়া জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুভাগ করেছে ভারতের সরকার। লাদাখকে কাশ্মীর থেকে পৃথক করে কেন্দ্রশাসিত বিশেষ রাজ্য করা হয়েছে।
এই কাশ্মীরের দখলদারিত্বের প্রশ্নে দুই পরাশক্তি ভারত ও পাকিস্তান একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৮৪ ও ১৯৯৯ সালে। এসব যুদ্ধে এই দুই দেশ কর্তৃক কাশ্মীরের দখলদারিত্বের সীমানা এদিক সেদিক হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরের অধিবাসীরা সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার জোগাড়। ভারত-পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধে জড়ালে জাতিসংঘ বলেছিল গণভোটের কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। কাশ্মীরের নিজস্ব রাষ্ট্র পাওয়ার স্বপ্নও পূরণ হয়নি।
পাকিস্তান ও চীন অধিকৃত কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন শোনা যায় না। পাকিস্তান অংশের নামই দেয়া হয়েছে ‘আজাদ কাশ্মীর’। কিন্তু ভারত অধিকৃত অংশে কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছে। ভারত যদি নিপীড়নের আশ্রয় না নিতো তাহলে হয়তো সেখানে শান্তি বিরাজ করতো। রাজনৈতিক প্যাচালে পড়ে তিন টুকরো কাশ্মীর এখন সেখানের অধিবাসীদের জন্য দুঃস্বপ্নের এক জীবনাচারণ। কাশ্মীরীদের জন্য দগদগে ঘা হয়ে আছে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ এ ভারতের কাটাতারের বেড়া। এই বেড়া পাকিস্তান ও ভারত অধিকৃত কাশ্মীরকে পৃথক করেছে। ফলে গ্রামের পর গ্রাম রাতারাতি পৃথক হয়ে যাওয়ায় আত্মীয় স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন দুপারের কাশ্মীরীরা।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে হায়দরাবাদ, কাশ্মীর, সিকিমসহ কয়েকটি স্বায়ত্বশাসিত এবং স্বাধীন অঞ্চলকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছে ভারত। ভারতের এই আধিপাত্যবাদ স্বভাবের কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোতে অস্থিরতা লেগেই থাকে। তাদের নিজেদের দেশেও অনেক রাজ্যে স্বাধীনতার দাবিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ আন্দোলন চলছে।
বৈষম্যমূলক শাসনের জন্য সৃষ্টি হয় ক্ষোভ। সেটা দমনের জন্য চালানো হয় নিপীড়ন। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সকল মজলুম জনপদকে এক হতে হবে। পরস্পরকে সাহস যুগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।